'হিমু'কে নিয়ে লেখা উপন্যাসগুলো যে খুবই হালকা গোছের, সেখানে কিছু কাঁচা কথা ছাড়া আর কিছু থাকে না, কোন কাহিনী থাকে না - এধরণের বহু অভিযোগ আজ পর্যন্ত শুনেছি। কিন্তু দুঃখের কথা, যাদের মুখ থেকে এ ধরণের স্টেটমেন্ট বেরিয়েছে তারা জীবনে কোনদিন হিমু বিষয়ক একটা বই পড়ে দেখেন নাই। যদি তারা হিমুকে নিয়ে লেখা কোন উপন্যাস পড়তেন তাহলে বুঝতেন, হুমায়ুন আহমেদ তা%র লেখক জীবনের সবচেয়ে সাহসী কাজগুলো করেছেন হিমুকে নিয়ে লেখা উপন্যাস সমূহের ভেতর। আর দশটা সাধারণ উপন্যাসে যে ধরণের কথাবার্তার উল্লেখ থাকলে নিঃসন্দেহে লেখককে তীব্র সমালোচনায় পড়তে হত, সেইসব কথাই অবলীলায় তিনি হিমুর মুখ থেকে বলিয়েছেন। রূপক ভাবে অসংখ্য বিতর্কিত ঘটনাকে তিনি উপস্থাপন করেছেন এই সিরিজের বইগুলোর মাধ্যমেই। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ কথাগুলো লেখক লিখেছেন হিমুকে নিয়ে লেখা দুইটি উপন্যাসে। সেই উপন্যাস দুটির একটি হল 'হিমুর নীল জোছনা'। অন্যটি 'হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম'। এই দুইটি উপন্যাসে লেখক সরাসরিভাবে আক্রমন করেছেন দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি, রাজনৈতিক দল আর রাজনৈতিক নেতাদের। 'হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম' উপন্যাসটির পটভূমি ছিল নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বেগবান হওয়া এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। আর 'হিমুর নীল জোছনা' বইয়ের পটভূমি ২০০৮ সালের নির্বাচন পরবর্তি সময়ে আওয়ামী সরকারের শাসনামল। 'হিমুর নীল জোছনা' বইটিতে একের পর এক বোমা ফাটিয়েছেন লেখক। কখনো তিনি ছাত্র রাজনীতির নামে রাজনীতি দলগুলো দেশের ছাত্রসমাজকে কিভাবে অনৈতিকতার চূড়ান্তে পৌঁছে দিচ্ছে তা তুলে ধরেছেন আবার কখনো তিনি ক্ষমতা দখলে মরিয়া রাজনীতিকদের বিচিত্র আচরণকে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে সরকারি দলের সাথে ঘটা যেকোন অপ্রীতিকর ঘটনাকেই আখ্যা দেয়া হয় বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র হিসেবে আবার ছাত্রলীগের কেউ অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হলে সরকার মহল দাবি করে অপরাধী মূলত শিবিরের লোক, ছাত্রলীগের সর্বনাশ করতে গোপনে দলে ঢুকেছে। রাজনৈতিক দলগুলো 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবির রহমান' আর 'মেজর জিয়াউর রহমান' এই দুইটি নামকে ব্যক্তি স্বার্থে বানিজ্যিকীকরণ করে চলেছে সেটাও দেখানো হয়েছে। উঠে এসেছে হলুদ সাংবাদিকতার চিত্র, পুলিশের ঘুষ খেয়ে অপরাধিকে ছেড়ে দেয়ার চিত্র। নির্দোষ ব্যক্তিদের জেলে পুরে বিখ্যাত সব মামলার আসামি বানিয়ে পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় কিভাবে নিজেদের আসল দায়িত্ব থেকে সরে আসছে সেটাও দেখানো হয়েছে। আর এত সবের মাঝখানে যেকোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কতটা চমকপ্রদ হয়, সেটা তো দেখানো হয়েছেই! এই বইয়ে সবচেয়ে বড় বোমাটি লেখক ফাটিয়েছেন হিমুর কন্ঠকে কাজে লাগিয়ে প্রশ্ন তোলার মাধ্যমে যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শেখ হাসিনার গ্রেপ্তারের সময় ছাত্রলীগের ভূমিকা কি ছিল যে তারা নিজেদেরকে দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ বলে দাবি করে। একজন সাহিত্যিক হিসেবে ক্ষমতাবানদের দিকে আঙ্গুল তোলা যে কতটা ঝুকিপূর্ণ তা লেখক জানতেন এবং এ জন্য এই বইয়ের ভূমিকায় লেখক সরাসরি এই বই লেখার প্রেক্ষিতে নিজের কি পরিণতি হতে পারে সে বিষয়ে শংকাও প্রকাশ করেন। হুমায়ুন আহমেদ তার লেখক জীবনে আড়াইশ'র বেশি বই লিখেছেন। অনেক বইয়ের বিষয়বস্তুর সাথে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির যোগাযোগ ছিল। কিন্তু সেসব স্থানেও লেখককে দেখা গেছে দুইদিক ব্যালান্স করে কথা বলতে। কিন্তু নিজের জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে, হিমু সিরিজের ২১তম বইতে এসে লেখক নিঃসংকোচে যেভাবে দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকারকে নিয়ে স্যাটায়ার করেছেন, তা তাঁর আগে কোন লেখককে ফিকশনধর্মী লেখার মাধ্যমে করতে দেখিনি। এ দিক থেকে ব্যাপারটা সত্যিই অভূতপূর্ব। ক্ষমতাবানদের নিয়ে লেখক কি কঠিন কঠিন সব রসিকতা করেছেন, তাঁর সাক্ষী হতে হলে 'হিমুর নীল জোছনা' বইটি পড়তেই হবে। হিমু এই বইতে দেশের প্রতিটি সচেতন ও নিরপেক্ষ মানুষের কন্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ এমনই এক বই যা শুধু হিমু ভক্তদেরই না বরং দেশ ও সমাজ সচেতন সকল পাঠকেরই দারুণ ভালো লাগবে। এত বিস্তারিতভাবে লেখকের দেশ ও দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে ভাবনার চিত্র অন্য কোন বইতে যে ফুটে ওঠে নাই তা বলাই বাহুল্য।
No comments:
Post a Comment