হুমায়ূনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র “আগুনের পরশমণি” কীভাবে নির্মিত হয়েছিলো, সে বিষয়ের খুঁটিনাটি নিয়েই এই বইটি লেখা। যেমন – চিত্রনাট্য তৈরি করা, টাকা যোগাড় করা, শট ডিভিশন ঠিক করা, পর্দার বাইরের ওস্তাদরা (সহকারী পরিচালক, সম্পাদক, চিত্রগ্রাহক, সঙ্গীত পরিচালক, সাউন্ড রেকর্ডিস্ট) কীভাবে কাজ করেন সেটার বর্ণনা, পাত্রপাত্রী ঠিক করা, সেট ডিজাইন ইত্যাদি। মুভিটা তৈরির পেছনে কী কী বিষয় প্রভাবকের কাজ করেছিলো, তৈরি করার সময় কী কী বাধা এসেছিলো এবং সেগুলো কীভাবে হুমায়ূন পার হয়েছিলেন, এসব বিষয়ও উঠে এসেছে বইয়ে। সেই সাথে বোনাস হিসেবে আছে মুভির পুরো চিত্রনাট্য, শেষে পুরো উপন্যাস।ঝকঝকে গ্লসি পেপারে প্রিন্ট করা বইটি আগুনের পরশমণি মুভির দুষ্প্রাপ্য (আমার মতে) সব স্টিল ছবি দিয়ে ভর্তি। মজার ব্যাপার হল, মুভির কলাকুশলীদের ছবি থাকলেও হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নিজের একটা ছবিও বইয়ে রাখতে দেননি। তিনি বলেছিলেন, অন্য কেউ যদি তাঁর ছবি বানানো নিয়ে বই লেখেন, তখন তিনি হুমায়ূনের বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবি ব্যবহার করবেন। কিন্তু এই বইটি যেহেতু উনি নিজে লিখেছেন, তাই উনার কোনো ছবি এখানে দিবেন না।ওয়ান ফাইন মর্নিং ঘুম থেকে উঠে হুমায়ূন চিন্তা করলেন, চলচ্চিত্র বানাবেন। কিন্তু একটা বিষয়ে চিন্তা করা আর সেটাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য কেমন, সেটা স্বপ্নবাজ মাত্রই জানেন। কিন্তু তারা আরও জানেন, যারা সত্যিই স্বপ্ন দেখেন, তারা সেটাকে বাস্তবায়িত করতে পিছপা হন না। একই কাহিনি আমরা দেখি সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রেও। তিনিও তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। তবুও পিছিয়ে আসেননি। আর তার ফলেই সৃষ্টি হয়েছিলো কালজয়ী “পথের পাঁচালি” মুভিটি।হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই! হাতে নেই টাকা, কিন্তু মাথা ভর্তি মুভি তৈরির স্বপ্ন, টেবিলে আগুনের পরশমণি উপন্যাসের চিত্রনাট্য (হুমায়ূনের মতে, চিত্রনাট্য তৈরি করা মানেই একটা ছবির ৫০ ভাগ কাজ শেষ করে ফেলা)। অবশ্য একজন জেদি আর আশাবাদী মানুষের জন্য বেশি কিছু দরকারও হয় না। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তারা কোনো না কোনো উপায় ঠিকই বের করে নেন। যেমন, চিত্রনাট্য প্রস্তুত করার পর টাকা যোগাড় না হওয়ায় যখন তিনি চিত্রনাট্য পুড়িয়ে এক কাপ চা বানানোর কথা চিন্তা করছিলেন, পাশাপাশি এও চিন্তা করেছিলেন, বাংলাদেশ সরকার তাঁকে অনুদান দিয়ে সাহায্য করবে কিনা? ফলে চা বানানোর বদলে চিত্রনাট্য বগলে নিয়ে তিনি রওনা দিয়েছিলেন তথ্যমন্ত্রীর অফিসে।একটা উপায় কাজ না করলে আরেকটা উপায় চিন্তা করার যে দক্ষতা তাঁর মধ্যে দেখলাম, দারুণ!বইটা পড়েছেন, কিন্তু পড়া শেষ করে “আগুনের পরশমণি” মুভিটি আরেকবার দেখেননি, এমন পাঠক মনে হয় বিরল! আমি তো পুরো বই শেষ না করে শুধুমাত্র কারিগরি অংশটুকু শেষ করেই দ্রুত বসে গিয়েছিলাম মুভিটা দেখতে। মুভি দেখেছি আর মিলিয়েছি, এখানে হুমায়ূন এভাবে লাইট ফেলেছিলেন; এখানে তিনি দৃশ্যটা নতুনভাবে টেক করেছিলেন। মর জ্বালা! সিনেমা দেখার বদলে তখন মাথায় ঘুরছিলো মুভি তৈরির মুহূর্তগুলো। তবে মূল উপন্যাসের তুলনায় মুভির দৃশ্যগুলো কেন এতোটা বদলে যায়, সেটা বুঝার জন্য এই বইয়ের তুলনা নেই।আমরা জীবনের কোনো না কোনো সময় চিন্তা করেছি, ‘উপন্যাসটা এতো সুন্দর! অথচ মুভিটা এর ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারেনি।’ কিন্তু কেন যে পারেনি, সেটা আমাদের বুঝে আসে না। এখন মোটামুটি বুঝেছি। কারণ উপন্যাসে একটা মুহূর্ত বর্ণনা করার জন্য অনেকগুলো লাইন লেখা যায়। কিন্তু ক্যামেরায় ঐ বিমূর্ত পরিস্থিতিটা সবসময় দেখানো সম্ভব হয় না। আবার একটা লাইন পড়ে আপনি যেভাবে দৃশ্যটা কল্পনা করবেন, পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি সেরকম নাও হতে পারে। তিনি হয়তো অন্যভাবে দৃশ্যটা কল্পনা করে তাঁর কল্পনাকেই পর্দায় ফুটিয়ে তুললেন। সেক্ষেত্রে ঐ কল্পনা আপনার মনঃপুত হল না, আর আপনি ঘোষণা দিলেন, ‘উপন্যাসের মতো মুভিটা সুন্দর না’। একটা মুভি নির্মাণ করতে গেলে যে কতো বড় আয়োজন করতে হয়, সেটা যে কী মহাযজ্ঞ, সে বিষয়ে আমার নাদান মাথায় প্রথম চিন্তা ঢুকিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর “অপুর পাঁচালি” বইটা ছিল “পথের পাঁচালি” মুভির নির্মাণকে ঘিরে। সে বই পড়ে প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম, চলচ্চিত্র কী জিনিস। এরপর সত্যজিতের মুভি নির্মাণ সংক্রান্ত আরও কিছু বই (বিষয় চলচ্চিত্র, একেই বলে শুটিং) সংগ্রহ করেছি। একই সাথে কিনেছিলাম হুমায়ূনের এই বইটি। ভাবলাম, সত্যজিতের একটা পড়া হয়েছে। এবার হুমায়ূনের একটা পড়ি। এরপর আবার সত্যজিতে ফেরত যাবো। আর কী আশ্চর্য! দুজন পরিচালকের গল্পেই কী অদ্ভুত মিল!
Wednesday, October 17, 2012
Chhobibananor Golpo By Humayun ahmed (ছবি বানানোর গল্প)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment