হুমায়ূন আহমেদ মেঘের ওপর বাড়ি তে বাস করতে চান। এ রকম একটি (অবচেতন) ভাবনা রূপ দিয়েছেন তাঁর মেঘের ওপর বাড়ি উপন্যাসটিতে। সম্প্রতি সেই উপন্যাসটি পড়ে শেষ করলাম। এত ছোট লেখাকে উপন্যাস বলতে আমার মন সায় দেয় না। তা সত্ত্বেও মেঘের ওপর বাড়ি পড়ার সময় যথারীতি ঘোর লেগেছে। পড়তে-পড়তে অভিভূত হয়ে ভাবছিলাম যে- ঠিক এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্যত্র হুমায়ূন আহমেদ- এর মতো ইন্দ্রজালিক লেখক আর ক’জন আছেন যিনি একটি অভূতপূর্ব ভাবনা কে লেখার মধ্যে অত্যন্ত সুচারু রূপে ছড়িয়ে দিতে পারেন? মনে হয় নেই। হয়তো আমার এই সিদ্ধান্তটি অনেকটাই অবেগপ্রসূত এবং যুক্তিহীন। কেননা, এরকম একটি সিদ্ধান্ত গ্রহনের পূর্বে পৃথিবীর সব লেখকের বইই একবার পড়ে নিতে হয়। তার পরও বলব যে হুমায়ূন আহমেদ সমসাময়িক বিশ্বের বিরল লেখকদের একজন। মনে হয় যে তিনি কেবল লেখক নন। তিনি একজন মহিমান্বিত জাদুকর, বেহালার সেই পাগানিনির মতে ... কিংবা মোর দ্যান দ্যাট ... আমার ঘরের বইয়ের আলমারীর তাকে ইতিহাস আর দর্শনের ঢাউশ বইয়ের ফাঁকে এই জাদুকর লেখকের লেখা কিছু কৃশকায় বই আছে বৈ কী। মাঝে-মাঝে আমি বইগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। এবং ভাবার চেষ্টা করি যে বাংলাদেশের একটি সাধারণ পরিবারে জন্ম-নেওয়া এই জাদুকরটি চিন্তার প্যার্টান এতটা ব্যতিক্রমধর্মী কেন? বাংলার ভাষায় কে এই লেখকের অগ্রজ? কে তাঁর পূর্বসূরি? কে তাঁকে পথ দেখিয়েছেন? জানি যে কেউ না। তিনি এতই অনন্য। এবং স্বাতন্ত্র। বাংলার ভাষার অন্য তালেবর লেখকদের লেখা পড়ার সময় হুমায়ূন আহমেদ-এর স্বাতন্ত্র স্পস্ট করেই যেন বোঝা যায়। তিনি লেখেন নিজস্ব ভাষায়। তাঁর লেখার প্লট এবং থিম ভিন্ন গোত্রের। মেঘের ওপর বাড়ি উপন্যাসটির প্লটটিও একেবারেই ভিন্ন গোত্রের। কিছুটা দার্শনিকচিন্তায় আচছন্ন মেঘের ওপর বাড়ি র ঘটনা তরতর করে এগিয়ে গিয়েছে। এবং ঘটনাপ্রবাহের ওপর হুমায়ূন আহমেদ-এর অসাধারণ নিয়ন্ত্রন দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি। (যারা একটুআধটু গল্প লেখার চেষ্টা করেন তারাই কেবল আমার এই কথার মানে বুঝতে পারবেন) ...যথার্থ শব্দ ও বাক্যের প্রয়োগ, যুক্তির গাঁথুনি একের পর এক সাজিয়ে তুলেছেন একজন নিঃসঙ্গ নির্জন কারিগর। লেখক মাত্রই নিঃসঙ্গ। তবে লেখকদের কারিগরি দক্ষতার মধ্যেও তো ফারাক রয়েছে। চিন্তাই তো যে কোনও লেখার ভিত্তি । এই জন্যই অভিভূত ভাবি যে ... এই বাঙালি জাদুকর লেখকটির চিন্তার প্যার্টান এতটা ব্যতিক্রমধর্মী কেন? মেঘের ওপর বাড়ি-র কাহিনি এরকম: একজন মানুষ (যিনি জীবদ্দশায় অধ্যাপক ছিলেন) তাঁর মৃত্যু হয়েছে। অবশ্য তিনি মৃত্যুর পরের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন। কেবল তাইই নয়, তিনি জীবিত আত্মীয়স্বজনের কথাবার্তাও শুনতে পারছেন। এমন কী তাদের চিন্তাও পরিস্কারভাবে উপলব্দি করতে পারছে। অধ্যাপকের মৃত্যুর কারণটি অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। এবং তার স্ত্রীকে সন্দেহ করা হয়। সন্দেহভাজন স্ত্রীটি সুন্দরী, উগ্র ধূমপায়ী, বুদ্ধিমতী এবং স্পস্টবাদী। অধ্যাপকের মৃত্যুরহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব পেয়েছে একজন অদ্ভূতুরে চরিত্রের গোয়েন্দা পুলিশ। এ ধরনের আধ-পাগলা চরিত্র নির্মাণে হুমায়ূন আহমেদ-এর দক্ষতা অপরিসীম। সে যাই হোক। শেষে অবশ্য দেখা গেল যে অধ্যাপকটির মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবেই হয়েছে। এবং তাঁর স্ত্রীটি নির্দোষ। স্ত্রীটি (ধূমপান করলেও) অতি ভালো মানুষ-যে কিনা ছোটবোনের অনাকাঙ্খিত (অটিস্টিক) সন্তানের দায়িত্ব নিয়েছে। এভাবে মেয়েটি কেবল ভালো মানষই নয়, মেয়েটির ভিতরে এমন কিছু গুণ/মহত্ত্ব রয়েছে যা অন্য মানুষের মধ্যে অনুপস্থিত। আর এভাবেই হুমায়ূন আহমেদ-এর মানবিক হৃদয়টি প্রকাশিত হয় । এবং এ ধরনের মানবিকতা বারবার আমরা তাঁর লেখায় পাই। স্ত্রীকে নির্দোষ দেখে মৃত অধ্যাপকটি মেঘের ওপর বাড়ি তে চলে যান ... হুমায়ূন আহমেদ-এর পাঠকমাত্রই জানেন যে এই মায়াবী লেখকটি দীর্ঘকাল ধরে এক ধরনের মৃত্যুচিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছেন। মৃত্যুর ঠিক পরের মুহূর্তগুলি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহের কথা সুবিদিত। আমার প্রায়ই মনে হয় যে হুমায়ূন আহমেদ লেখার মাধ্যমে পাঠকের কাছে তাঁর এই ভাবনাটি পৌঁছে দিতে চান। এসব কারণে হুমায়ূন আহমেদ কে মনে হয় জীবনমৃত্যুর রহস্যে আচ্ছন্ন এক ঘোরলাগা মানুষ। কখনও আধুনিক বিজ্ঞানের কাঠামোয় জীবনমৃত্যুর রহস্য বিষয়টি তিনি বোঝার চেস্টা করেন। স্টিফেন হকিং ও লিওনার্দ ম্লোদিনাও- এর লেখা The Grand Design বইতে যখন পড়ি যে: “পদার্থবিদ্যা ও অধিবিদ্যার মধ্যে দূরত্ব কমে আসছে।” তখন আমার হুমায়ূন আহমেদ- এর কথা মনে হয়। আবার এও দেখেছি যে ... হুমায়ূন আহমেদ কখনও - কখনও সমাজের প্রচলিত বিশ্বাসটি বোঝার চেষ্টা করেন ওই মৃত্যুরহস্য উদঘাটনের জন্যেই । মৃত্যুর প্রতি তীব্র আকর্ষণ থাকলেও জীবনের প্রতিও হুমায়ূন আহমেদ-এর আকর্ষন কম নয়। এই কারণেই কি তিনি গান লেখেন? যে গানে উঁকি দেয় মায়াভরা বাংলার মানুষ ও প্রকৃতি। জোছনাপ্রিয় এই লেখকটি প্রচলিত অর্থে মরমি না হলেও হুমায়ূন আহমেদ কে মরমি আখ্যা দেওয়া চলে। (মাঝেমাঝে ভাবি তাঁর মতো রবীন্দ্রপ্রেমীই- বা ক’জন আছে) ... রবীন্দ্রনাথের গান বাদেও বাংলার লোকগানের প্রতি হুমায়ূন আহমেদ-এর গভীর আকর্ষনের কথা সর্বজন বিদিত। এই যে সুনামগঞ্জের বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম-এর কথা শহরবাসী জানতে পারল-তার পিছনে হুমায়ূন আহমেদ- এর অবদান তো কম নয়। আবদুল কুদ্দুস বয়াতীর প্রসঙ্গেও একই কথাই প্রযোজ্য। এমন একজন ঘোরলাগা মানুষ যে মেঘের ওপর বাড়ি-র কল্পনা করবেন - সে রকমই তো স্বাভাবিক। ঘোরলাগা রহস্যপ্রেমী লেখকটি কি সেই মেঘের ওপর বাড়ি তে বাস করতে চান? কিন্তু মেঘের ওপর বাড়িটি ঠিক কোথায়? অনুমান করি যে মেঘের ওপর বাড়িটি মাটির পৃথিবীর অনেকই উর্ধে । কি উপকরণ দিয়ে বাড়িটি নির্মিত কে জানে। হয়তো সেই বাড়িটিও অদৃশ্য মায়ায় তৈরি। এই জীবনের মতোই ... দু-বাংলার নতুন প্রজন্ম তাঁর লেখা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পাঠ করে। আমি কেবল সেটুকু দেখিনা। আমি দেখি লেখকটিকেও । জীবনে বেঁচে থেকে জীবনরহস্যের কূলকিনারা করতে না-পারার অস্থিরতা যে লেখকটিকে তাড়া করে বেড়ায়। এই অস্থিরতা আমি যেন বেশ বুঝতে পারি। তাঁর প্রতি যখন বর্ষিত হয় নিন্দা- আমি তখনও দেখি তাঁকে। কেমন অবিচল। অবিচল আর স্থির। যেন অগভীর সমালোচনা তাঁকে কাবু ও বিপর্যস্ত করতে পারছে না। কেবল তিনি এক ফোঁটা লিলুয়া বাতাসের স্পর্শের জন্য উদগ্রীব। এ কারণেই হুমায়ূন আহমেদ মরমি। পড়তে পড়তে মেঘের ওপর বাড়ি যেন হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল। হুমায়ূন আহমেদ- এর বেশির ভাগ লেখাই এই রকমের। হঠাৎ করেই যেন শেষ হয়ে যায়। আজ এই মরমি লেখকটির জীবনও যেন ৬৩ বছর বয়েসে পৌঁছে হঠাৎ করেই থমকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ৬৩- কি এমন বয়স? তবু তাঁর দেহে বাসা বাধা মরণব্যাধির কারণে আমাদের এক অস্বস্তিকর আশঙ্কা ঘিরে ধরেছে ... হুমায়ূন আহমেদ হয়তো একদিন অনন্তকালের জন্য মেঘের ওপর বাড়ি তে চলে যাবেন। সেই মেঘের ওপর বাড়ি-র অলিন্দে দাঁড়িয়ে থেকে দেখবেন নীচের দৃশ্যাবলী । এ রকম স্বপ্ন তো তাঁর দীর্ঘদিনের। যেন তিনি অপেক্ষায় আছেন। এখন যেন তাঁর স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে ...
Saturday, February 18, 2012
Megher.Opor.Bari By Humayun Ahmed (মেঘের উপর বাড়ি)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment