আমরা কেউ বাসায় নেই
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ
হালকা গোছের মজার উপন্যাস, হুমায়ুন আহমেদের অন্যান্য উপন্যাসের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন ধরণের
হুমায়ুন আহমেদ নিজেই বিভিন্ন আত্মজৈবনিক রচনা ও সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসেরই ধরাবাঁধা কোন প্লট থাকে না। কোন একটা জায়গা থেকে তিনি কাহিনীর প্রস্তাবনা শুরু করেন এবং তারপর কাহিনী নিজস্ব গতিতে এগোতে থাকে। একটি লাইন লিখবার আগমুহুর্তেও তিনি ঠিক করে নেন না যে সেই লাইনটা কেমন হতে যাচ্ছে। 'বাদশাহ নামদার' বা 'জোছনা ও জননীর গল্প' এর মত উপন্যাসগুলো হয়ত ব্যতিক্রম তবে বেশিরভাগ উপন্যাসেই তিনি এই রীতি অনুসরণ করেছেন।
কিন্তু 'আমরা কেউ বাসায় নেই' উপন্যাসের শুরুতেই তিনি প্রতিটা চরিত্রকে বেশ সচেতনভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং তার ফাঁকে ফাঁকে তিনি কোন একটা গল্পের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ থেকে আমার ধারণা হয়েছিল, এই উপন্যাসটি হয়ত লেখকের অন্যান্য উপন্যাসের মত না। নির্দিষ্ট একটা প্লট মেনটেন করে লেখক এগোচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ঘটনা পুরোই উল্টো। একই সাথে এই উপন্যাসে দ্বৈত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
প্রথমত, লেখক এই উপন্যাসের প্রতিটি পরিচ্ছেদ রচনার আগেই সে সম্পর্কে ব্যাপক চিন্তা ভাবনা করেছেন বলে মনে হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে তিনি উপন্যাস রচনাকালে মাথায় যা আসবে তাই লিখব ধরণের পন্থা অনুসরণ করেন নি। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন নির্দিষ্ট থিমের উপর যথাসম্ভব মজা করে একেকটি দৃশ্য বা ঘটনাকে সাজাতে।
দ্বিতীয়ত, লেখক ভেবেচিন্তে উপন্যাসটি লিখেছেন এটা যেমন সত্যি, তেমনি আরেকটা সত্যি হচ্ছে এই উপন্যাসের কোন কাহিনীই নেই! হুমায়ুন আহমেদের প্রায় সকল উপন্যাসের গতিপ্রকৃতিই নিজস্ব গতিতে সঞ্চারিত হলেও একটা সময় এসে কাহিনীতে ঠিকই প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছে। তাই বোঝার উপায় নেই যে লেখার শুরুতে লেখক নিজেও জানতেন না শেষে কি হতে চলেছে। কিন্তু 'আমরা কেউ বাসায় নেই' উপন্যাসে দেখলাম, আগে থেকে বিষয়বস্তু ঠিক করে রেখে এবং প্রতিটি পরিচ্ছেদের কাহিনীই অত্যন্ত মজার ও উপভোগ্য করে তুললেও শেষ পর্যন্ত লেখক সামগ্রিকভাবে একটি পরিচ্ছেদের কাহিনীর সাথে অন্য পরিচ্ছেদের কাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। (এই কথাটাকে কেউ নেতিবাচক অর্থে নেবেন না আশা করি)
সত্যি কথা বলতে কি, এই উপন্যাসের আঙ্গিক গঠনটাই একেবারে অন্যরকম। শুরুতেই লেখক একেবারে ডিটেইলে প্রধান চরিত্রদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। অপরদিকে পরবর্তি প্রতিটি পরিচ্ছেদেই নির্দিষ্ট কোন ঘটনাকে ফোকাস করা হয়েছে। তাই সেগুলো একেকটা স্বতন্ত্র গল্পে পরিণত হয়েছে। ফলে পাঠক যদি শুরুতে চরিত্রসমূহ সম্পর্কে জেনে নিয়ে পরবর্তিতে উপন্যাসের মাঝখান দিয়ে যেকোন একটা পরিচ্ছেদ পড়া শুরু করেন, তাহলেও খুব বেশি সমস্যায় না পড়েই তারা কাহিনীর সাথে নিজেদের রিলেট করতে পারবেন।
উপন্যাসের শুরুতেই কথক মনজুর ভাই টগরের অদ্ভুত চরিত্র ও নিজস্ব ধর্ম প্রচারের বিষয়টি এবং মনজুদের বাড়ি পদ্ম ও তার মায়ের উঠে আসার ব্যাপার দুটি রয়েছে। কাহিনীতে মূল নাটকীয়তা মূলত ঐ দুই জায়গায়ই ছিল। এরপরও লেখক স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে প্রতিটা দৃশ্যকে নিজের মত করে নাটকীয় ও মজাদার করে তুলতে চেয়েছেন। তবে সেগুলোতে খুব বেশি নতুনত্ব নেই। অবশ্য লেখক একেবারে পারফেক্ট টাইমিংয়ে যেভাবে প্রতিটা দৃশ্যে হিউমার সংযোজন করেছেন, তা এক কথায় অসাধারণ।
প্রথমেই বলেছি এই উপন্যাসের নির্দিষ্ট কোন কাহিনী নেই। সুতরাং কাহিনী সংক্ষেপ সম্পর্কে জানানোর বিষয়টিও অপ্রয়োজনীয় মনে করছি। তবে এটুক জানিয়ে রাখি যে উপন্যাসের গতিপ্রকৃতি আবর্তিত হয়েছে একটি পরিবারের বিচিত্র সব চরিত্রের আজব কর্মকান্ডকে ঘরে। উপন্যাসের প্রতিটা চরিত্রই অসাধারণ, অর্থাৎ সাধারণত এই ধরণের চরিত্র বাস্তবজীবনে দেখা যায় না। আর তাই এই উপন্যাসটিও সত্যিকারের জীবনঘনিষ্ট বা সামাজিক উপন্যাস হয়ে উঠতে পারেনি। উপন্যাসের বিভিন্ন দৃশ্যের মাধ্যমে হয়ত লেখক সাম্প্রতিক কালের সিরিয়াস কিছু দিককে স্যাটায়ারের মাধ্যমে প্রকাশ করতে চেয়েছেন তারপরও আমার কাছে মনে হয়নি এই উপন্যাসে গভীর জীবনবোধের কোন ব্যাপার আছে যার দেখা মেলে হুমায়ুন আহমেদের অন্যান্য উপন্যাসে।
সবমিলিয়ে 'আমরা কেউ বাসায় নেই'কে নিছকই একটা হালকা গোছের মজার উপন্যাস বলে মনে হয়েছে আমার। টিভির প্যাকেজ কমেডি নাটক বা টেলিফিল্ম নির্মানের ক্ষেত্রে এই ধরণের উপন্যাসের কাহিনী আদর্শ।
No comments:
Post a Comment